Image by Erico ericojr from Pixabay |
হার্ড শব্দটির অর্থ পশুর পাল বা পশুর দল আর ইমিউনিটি মানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। আসলে হার্ড ইমিউনিটি শব্দটি মূলত পশুদের রোগপ্রতিরোধ পদ্ধতি থেকে এসেছে। ১০০ টি গরুর মধ্যে যদি ৮০ টি গরুকে কোন নির্দিষ্ট রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া হয় তবে ৮০টি গরু ঐ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করবে। তাহলে ঐ ৮০টি গরু নতুন করে ঐ নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত হবেনা। ফলে বাকি বিশটি গরুতে তাদের দ্বারা রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম। এভাবে গরুগুলোর মধ্যে ঐ রোগটি আর ছড়াতে পারবে না। রোগটি ধীরে ধীরে বিদায় নিবে।
তবে হার্ড ইমিউনিটি দুই ভাবে অর্জন করা যায়। একটি হল ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে আরেকটি রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে। কেননা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে শরীরে যেমন ভাইরাসটির বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হয়ে ঐ ভাইরাসটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে ঠিক তেমনি কেউ ভাইরাল রোগে আক্রান্ত হলেও তার শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়ে ঐ ভাইরাসটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। তাহলে ভ্যাকসিন নেওয়ার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করা ভাল নাকি রোগে একবার আক্রান্ত হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করা ভাল? নিশ্চয়ই ভ্যাকসিন সর্বোত্তম। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি যখন পোলিও ভ্যাকসিন নিবেন তখন আপনার শরীরে পোলিও রোগটি হবেনা তবে আপনার শরীরে পোলিওর বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হয়ে থাকবে যা সারাজীবন আপনাকে পোলিও রোগ থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু আপনি যদি ভাবেন, পোলিও ভ্যাকসিন না নিয়েও একবার পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে পোলিওর বিরুদ্ধে সারাজীবন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করবেন, সেটাও সম্ভব। তারমানে একবার পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্ব লাভ করেন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেন যাতে আর কোনোদিন আপনার পোলিও না হয়। হ্যা, একবার পোলিও আক্রান্ত হলে দ্বিতীয়বার আপনার পোলিও রোগটি হবেনা সত্য। কিন্তু প্রথমবারেই পোলিও আক্রান্ত হয়ে আপনি পঙ্গুত্ব লাভ করতে পারেন এমনকি মারাও যেতে পারেন।
তবে কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে। সকল ভাইরাসের বিরুদ্ধে সমানভাবে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করা যায় না। কোনও কোনও ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা স্বল্পমেয়াদী হয় আবার কোনও কোনও ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা দীর্মেঘয়াদী। যেমন- বসন্ত একবার হলে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা যুগের পর যুগ কার্যকর থাকে। ফলে আপনার একবার বসন্ত হলে পরবর্তী জীবনে বসন্ত হওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, সবার শরীর সমানভাবে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করতে পারে না। যেমন- এইচআইভি ও ক্যানসার আক্রান্ত এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের ইমিউনিটি সিস্টেম দুর্বল থাকে। ফলে তারা সবচাইতে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এদেরকে ভ্যাকসিন দেওয়া যায়না এবং ভ্যাকসিন দিলেও ইমিউনিটি দুর্বল হওয়ার কারণে কোন রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়না বরং ক্ষতি হতে পারে।তাই এসব ব্যক্তি রোগে আক্রান্ত হলে, মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে।
চলুন গরুর গল্পে ফিরে আসি। একটি উদাহরণ দিয়ে বলি যদিও উদাহরণটি পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। ধরুন, গরুগুলোকে বোভিন-রেস্পিরেটরি ভ্যাকসিন না দিয়ে বরং গরু গুলোকে আমরা বোভিন-রেস্পিরেটরি ভাইরাসে আক্রান্ত হতে দিয়ে তাদেরকে বোভিন-রেস্পিরেটরি রোগ প্রতিরোধক্ষম করে তুলি। দেখা গেল, পালের ১০০ টি গরুর মধ্যে ৯০টি আক্রান্ত হল, বাকি ১০টি ভাগ্যক্রমে আক্রান্ত হল না। আক্রান্ত ৯০টির মধ্যে ১০ টি গরু মারা গেল এবং ৮০টি সুস্থ হয়ে উঠলো। যে ৮০টি গরু বোভিন-রেস্পিরেটরি রোগ হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠলো তাদের শরীরে বোভিন-রেস্পিরেটরি রোগের এন্টিবডি তৈরি হল এবং পরবর্তীতে ওই গরুগুলো আর বোভিন-রেস্পিরেটরি রোগে আক্রান্ত হয়নি এবং রোগটি ছড়ায়নি। ধীরে ধীরে বোভিন-রেস্পিরেটরি রোগের প্রাদুর্ভাব শেষ হল। অবশেষে হিসেব দাঁড়ালো, মোট ৯০টি গরু জীবিত থাকলো যার ভিতর ৮০ টি গরুর শরীরে বোভিন-রেস্পিরেটরি রোগের এন্টিবডি আছে। তাহলে অধিকাংশ গরুই এখন বোভিন-রেস্পিরেটরি প্রতিরোধক্ষম অর্থাৎ গরুর পালটি এখন হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করেছে। এই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে গিয়ে কিছু ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল, যেমন - ১০টি গরুকে বোভিন-রেস্পিরেটরি রোগে প্রাণ দিতে হয়েছিল। আর ভালো দিকগুলো হল- অধিকাংশ গরু ইমিউনিটি অর্জন করেছে, আক্রান্ত না হওয়া গরুগুলোর মধ্যে যেগুলোর ইমিউনিটি দুর্বল ছিল সেগুলোও কিন্তু বেঁচে গেল।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, ৮০ টি গরু যেহেতু ইমিউনিটি অর্জন করেছিল এবং পরবর্তীতে আর আক্রান্ত হয়ে রোগ ছড়ায়নি তাই ১০ টি গরু বোভিন-রেস্পিরেটরি রোগে আক্রান্ত না হওয়ার পিছনে এটি বড় একটি কারণ। মনে রাখবেন, যে ১০টি গরু আক্রান্ত হয়নি তাদের সবার ইমিউনিটি যে সবল ছিল এমনটা নয় বরং রোগের বিস্তার কমে যাওয়ায় তারা ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেনি এবং আক্রান্তও হয়নি।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, ৮০ টি গরু যেহেতু ইমিউনিটি অর্জন করেছিল এবং পরবর্তীতে আর আক্রান্ত হয়ে রোগ ছড়ায়নি তাই ১০ টি গরু বোভিন-রেস্পিরেটরি রোগে আক্রান্ত না হওয়ার পিছনে এটি বড় একটি কারণ। মনে রাখবেন, যে ১০টি গরু আক্রান্ত হয়নি তাদের সবার ইমিউনিটি যে সবল ছিল এমনটা নয় বরং রোগের বিস্তার কমে যাওয়ায় তারা ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেনি এবং আক্রান্তও হয়নি।
কিন্তু মানুষতো গরু বা ভেড়া নয়। মানুষকে কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে কতটা ক্ষতি স্বীকার করতে হবে আসুন তার একটা হিসেব কষি। যেহেতু করোনার কার্যকরী কোন টীকা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি, তাই করোনা বা কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করার একমাত্র উপায় অধিকাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়া। এপিডেমিওলোজির ভাষায়, বিভিন্ন রোগের হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য মোট জনগোষ্ঠীর কতটুকু অংশ আক্রান্ত হতে হবে তার বিভিন্ন শতকরা হার নির্ধারণ করা আছে। যদি করোনার ক্ষেত্রে এটি মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ হয় তবে ১০০ জন মানুষের মধ্যে ৮০ জন মানুষকে করোনায় আক্রান্ত হতে হবে। এই হিসেবে, বাংলাদেশে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি মানুষকে করোনায় আক্রান্ত হতে হবে। যদি করোনায় মৃত্যুহার শতকরা ১ ভাগও হয় তাহলে ১৪ কোটি করোনা আক্রান্তের মধ্যে বাংলাদেশের ১৪ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হবে। এটা গরু বা ভেড়ার ক্ষেত্রে হিসেব কষলেও মানুষের ক্ষেত্রে চিন্তা করাও দুরূহ ব্যাপার। যেহেতু করোনা ভাইরাস সম্পর্কে এখনও অনেককিছু অজানা রয়ে গেছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেই যে আমরা দীর্ঘমেয়াদী ইমিউনিটি অর্জন করবো তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?
তাই এর সর্বোত্তম সমাধানের জন্য কার্যকরী টীকা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি, ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, গ্রহণ করতে হবে শাকসবজি-ফলমূলসহ সকল ধরনের পুষ্টিকর খাবার যাতে ইমিউনিটি আরো শক্তিশালী হয়।
বিঃদ্রঃ এখানে যে হিসেব গুলো দেখানো হয়েছে তা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করবেন না। এটি বিজ্ঞানের আলোকে লেখকের নিজস্ব অভিব্যক্তি।
বিঃদ্রঃ এখানে যে হিসেব গুলো দেখানো হয়েছে তা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করবেন না। এটি বিজ্ঞানের আলোকে লেখকের নিজস্ব অভিব্যক্তি।
Categories:
জ্ঞান দৈনন্দিন
0 comments: