করোনা কালে মধ্যবিত্ত আমান সাহেবের দিনগুলি
সরকার ঘোষণা করেছে সাধারণ ছুটি আর অনেক জেলা বা অঞ্চলকে করেছে অবরুদ্ধ। তবুও কী থমকে দিতে পেরেছে করোনার ভয়াল গ্রাস।বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও ভাল। গণমাধ্যমে তাকালেই যেন বিশ্বজুড়ে করোনা মৃত্যুর মিছিল। উন্নত বিশ্বসহ সবাই যেন আজ উচ্চ সংক্রমণকারী এই ভাইরাসের পায়ে মাথা নত করেছে। বৈশ্বিক এই মহামারীতে আকাশের দিকে তাকিয়ে সবার মুখে একটি কথাই ধ্বনিত হচ্ছে "রক্ষা কর প্রভু"।
আসুন দেখি কেমন কাটছে বেসরকারি কর্মকর্তা আমান সাহেবের এক একটি দিন। সংস্থা বলেছে বাসায় থেকে অফিসের কাজ করেন যাতে বেতনটা হালাল হয়। বউ বলে অফিসতো অনেক হলো, এবার নাহয় গৃহস্থালির কাজে একটু মনোযোগ দাও। এক শতাব্দীতেও এমন সুযোগ আসেনা। কি আর করার স্ত্রী সন্তান ছাড়া আর কে আছে। তাই তাদের দাবিগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই রীতিমতো সহধর্মিণীর পরামর্শক্রমে পনের দিনের অগ্রিম বাজার করা হল। দুঃখের বিষয় হল তার স্ত্রী আমিনার ফেসওয়াস আর কি জানি একটা ক্রিম আনা সম্ভব হয়নি। প্রিয়তমার হরিণী নয়ন দুটি যেন মূহুর্তেই ব্যাঘ্র চোক্ষে পরিণত হল। বুঝিয়ে বললো মুদি, কাঁচামাল আর ওষুধ ছাড়া সব দোকান বন্ধ। স্বামীকে ভালবাসে আবার শ্রদ্ধাও করে তাই স্ত্রী ভাবলো এই রূপ-সৌন্দর্য স্বামীর চললে তার রূপচর্চার দরকার কী।আর এমনি যেভাবে করোনা ছড়াচ্ছে তাতে বাচিঁ না মরি সেটাইতো বড় উদ্বেগের বিষয় সেখানে রূপ যৌবন মূখ্য নয়।সন্তান, স্বামী আর নিজের জীবন রক্ষার জন্য যেনো সে আল্লাহ্র কাছে ফরিয়াদ করে যাচ্ছে। সে বেশী উদ্বিগ্ন যে সন্তানের মাসখানেক এর মত স্কুল ছুটি, ছেলেটা কতদিন থেকে সূর্যালোকে খেলতে পারেনা সবসময় অজ্ঞাত জেদ করেই চলছে। আমান সাহেব মানবিক সংস্থায় কাজ করে, মনটাও অনেক মানবিক, সুচরিত্রের অধিকারীও বটে। হাতে নগদ যা ছিল এমতাবস্থায় মানব কল্যাণে সে টাকা দান করেছে। একদিকে তার স্ত্রী-সন্তানসহ ছোট পরিবার নিয়ে করোনাভীতি আর অন্যদিকে দূরে অবস্থানরত মা-বাবা আর আপনজনদের নিয়ে চিন্তা। আবার বাসায় থাকলেও অফিস কাজের চাপ আছে, প্রয়োজনে মাঠে কাজে যেতে হবে সে তো এনজিওকর্মী। যেখানে রহিমের চা আর সহকর্মীদের সাথে খোশগল্প তার নিত্যদিনের মনের খোরাক যোগায় সেখানে পনের দিন ঘরবন্দী আমান যেনো জেল খানার পুরোনো কয়েদি।
জমজমাটপূর্ণ রহিমের দোকানটা যেনো ধুধু শশ্মান হয়ে গেছে। সহকর্মীরা সবাই যেনো খিল লাগিয়ে ঘরে বসে আছে। সবার মনে যেনো এক করোনা বিষাদ বয়ে যাচ্ছে।
স্ত্রী সন্তানের শুষ্ক মুখটা দেখে নিজের খারাপ লাগাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। সন্তান যখন বলে কবে বাইরে ঘুরতে যাব, আমান নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, যখন বলে আমার সবাই কি মরে যাবো, ছোটদেরও কি করোনা হয়?নির্বাক আমান অশ্রু ধরে রাখতে পারেনা। একটিমাত্র ছেলে যেনো তার কলিজার টুকরা। পাচঁ বছরের সন্তানের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। কিভাবে উত্তর দিবে পৃথিবীর সকল বিজ্ঞানী মিলে একটি প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি এখনও। আমান নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যে করোনা রোগ এত ভয়াবহ নয় যে হলেই মরতে হবে কেননা এর মৃত্যুহার শতকরা পাচঁ থেকে দশ ভাগের বেশি নয়। নব্বই থেকে পঁচানব্বই ভাগ মানুষতো বেচেঁ থাকবে আর মরতেতো হবেই একদিন। জীবনে অনেক ছুটি কাটিয়েছে সে। ঈদের ছুটি, পুজোর ছুটি হরেক রকম ছুটি। ছুটি মানেই যেনো আনন্দের পসরা। ছুটি মানেই যেনো পরিবারসহ কেনাকাটা, বিশেষ খাওয়া দাওয়া, ঘুরতে যাওয়া আর আপনজনদের খবর নেয়া। কিন্তু এবারের ছুটি যেনো দুঃখ বেদনা আর বিষাদের সবচেয়ে খারাপ রূপটি নিয়ে উদ্ভূত হয়েছে ।
করোনাময় দিনগুলি করুণাময়ের দয়ায় কোনোভাবে কেটে যাচ্ছে তার। তিন বেলা খাওয়া, টেলিভিশনে করোনা খবর দেখা আর ফেসবুকের আজব গুজব করোনা লেখা করোনা গান শুনে আর করোনা ভিডিও দেখে কাটছে, সাথে বাড়িভিত্তিক অফিসের কাজ। আগে ছুটি শেষে ওজন বাড়লেও এবার তার ব্যতিক্রম, গড়ে এক দুই কেজি করে কমে গেছে। খাবার খেলেও যেনো শরীরে কাজে দিচ্ছে না, এক অদৃশ্য পিড়া যেনো পুষ্টি টেনে নিচ্ছে। আমিনাকে স্লিম শরীরে আকর্ষণীয় লাগলেও ওটাতো প্রকৃত না বরং করোনা ভয়ে সৃষ্ট বলে মনে হয়। ছেলেটার রুচি নেই, জেদ বেরেছে, কতদিন ঘরে রাখা যায়।
এখন তার একটি চাওয়া , করোনা যেনো না ছড়াতে পারে। তার চোখেমুখে প্রশ্ন, কবে সবাই আগের মত স্বাভাবিক জীবন যাপন করব? কবে ছোট্ট শিশুগুলো বাইরে খেলাধুলা করব? কবে রহিমের চা দোকানগুলো আবারও জমজমাট হবে? পরিস্থিতি কি আরও খারাপ হতে পারে? আর দিনমজুর দের ভাতের জন্য কাজের অভাব হবেনা?